২০ জুন কবি সুফিয়া কামালের জন্মদিন। কবি সুফিয়া কামালকে নিয়ে লিখেছেন— স্বাতী চৌধুরী।

কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী কবি সুফিয়া কামালকে নিয়ে লিখেছিলেন—
‘দুই হাতে অন্ধকার প্রাণপণে ঠেলে ঠেলে
দৈত্য বধের কঠিন সত্য বুকে ধরে
তুমি এলে।
একটি মাটির প্রদীপ থেকে লক্ষ প্রদীপ জ্বেলে
তুমি এলে।’

যুগে যুগে নাকি এক একজন মহাপুরুষ আসেন সাধারণ নিপীড়িত অসহায় মানুষের ত্রাতার ভূমিকায়। তিনি এসে তাদের টেনে তোলেন, পথ দেখান। তাদের আবির্ভাবে এক একটা যুগ পাল্টে যায় তাই তারা যুগাবতার বা যুগস্রষ্টা। তবে এ পর্যন্ত এরূপ অভিধায় যাদের নাম আমরা জানি তারা সবাই পুরুষ। কিন্তু যুগ পরিবর্তন করার ক্ষমতা সম্পন্ন যদি কারোর জন্ম বা আবির্ভাব যুগাবতার হওয়ার সূচক হয় তবে কোনো দেশ বা সমাজে যেসব নারীর আবির্ভাবে নারীর জীবনে তো বটেই সেই সমাজ রাষ্ট্রেও যদি ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়, সূচনা হয় নতুন যুগের তবে সেই নারী কি যুগাবতার হতে পারেন না? আমি মনে করি যুগাবতার হওয়ার যোগ্যতা সাপেক্ষেই তিনি যুগাবতার বা যুগস্রষ্টা। তিনি নারী না পুরুষ সেটা বিবেচ্য হওয়া ঠিক নয়। তাই যদি হয় তবে এ রকমই একজন যুগস্রষ্টা জননী সাহসিকা, কবি সুফিয়া কামাল। যার নামের আগে অনেক অভিধা ব্যবহার করা হয় এবং সব অভিধাই তার বহুরৈখিক কাজের সঙ্গে যুক্ত যে কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি এ রকম অবস্থা। তবে তার প্রথম পরিচয় একজন কবি এটাই আগে এসে যায়। সেই শৈশব থেকে তার মাঝে কবিসত্তার স্ফূরণ ঘটেছিল যা তিনি আজীবন লালন করেছেন এবং এ কবিসত্তার মধ্য থেকেই তার আর সব কর্মকাণ্ডের ব্যাপ্তি ঘটেছে। আর তিনি একজন জননী তবে শুধুই জননী নন একজন জননী সাহসিকা।

সব জননীই তার সন্তানের জন্য সাহসী হয়ে উঠতে পারে কিন্তু তিনি যে এ দেশের সব মানুষের এক শাশ্বত জননী! একজন জননী সাহসিকা যে তার সন্তানদের জন্য হায়েনার বিরুদ্ধেও লড়তে পারেন, তার মুখের ওপর কড়া প্রতিবাদ করতে পারেন। একবার বাঙালিকে হায়ান বা জানোয়ার বলেছিল স্বৈরশাসক আয়ুব খান। কবি সুফিয়া কামাল জবাব দিয়েছিলেন ‘তবে আপনিও তো সেই জানোয়ারের প্রেসিডেন্ট।’ সেই বাঙালির অপমান তিনি কী করে মেনে নেন যে বাঙালির ভাষা বাংলায় লেখালেখির জন্য, বাংলায় কথা বলার জন্য, বাঙালিদের সঙ্গে মেলামেশার জন্য, তিনি তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন!

তার নিজের কথায় জানা যায়-‘অনেক বাধা-বিপত্তির ভেতর দিয়েই আমাকে লিখতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। কেবল মা আমার সঙ্গে ছিলেন। আমি আমার মা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম পরিবার খেকে। কারণ বাংলায় লেখালেখি, বাংলায় কথা বলা, বাঙালিদের সঙ্গে মেলামেশা, সমাজসেবার জন্য পর্দা ছাড়া বোরখা ছাড়া বাইরে বের হওয়া আমাদের পরিবারের জন্য বেইজ্জতির ব্যাপার ছিল’।

সেই বেইজ্জতির ব্যাপারকে থোড়াই পরোয়া করে একজন সদ্য বিধবা তরুণীর পক্ষে শুধু লেখার জন্য প্রাত্যহিক আরাম আয়েশ ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনকে দু’হাতে ঠেলে দিয়ে অভাব অনটনে ভরা অনিশ্চিত জীবনকে বরণ করে নিলেন সেও কি ভাবা যায়? ভাবতে পারবে বা পেরেছে ক’জন আমি জানি না। তবে সুফিয়া কামাল যে পেরেছিলেন সে তো অনেকেই জানে। তিনি তার জীবনসঙ্গী সৈয়দ নেহাল হোসেনের মৃত্যুর পর সেই যে বেরিয়ে এলেন তার মামার শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবার থেকে আর ফিরে যাননি।
হ্যাঁ, তিনি এসেছিলেন তার সময়কে অতিক্রম করে। আর ভাবলে অবাক লাগে যে তার থেকে এক শতাব্দী পর আজ আমরা আমাদের সময়কেও ধারণ করতে পারছিই তো বরং এমন অনেক আছি যারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও নিজেদের সময় থেকে বহুদূর পিছিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তিনি এসেছিলেন তার নিজের ভেতরের আলো থেকে আলো জ্বেলে জ্বেলে। সেই আলোকে মশাল বানিয়ে অন্ধকার বিদূরিত করেছেন। পাথর কেটে পথ তৈরি করেছেন। খানাখন্দ ভরাট করে পথ তৈরি করেছেন। আর আমরা সেই পথে হেঁটেছি কেবল নিজের মঞ্জিল মকসুদে পৌঁছতে। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব ছিল পাথর কাটা সে পথ, খানাখন্দ ভরা সুরকি বিছানো সেই পথকে পাকা সড়ক, পাকা সড়ক থেকে পিচঢালা মসৃণ হাইওয়ে বানিয়ে সর্বসাধারণের চলাচলকে নির্বিঘ্ন করে তোলার। অথচ তার জন্য আমরা অনেকেই আর কোনো পরিশ্রম করিনি। সে পথ থেকে যে যতটুকু পেরেছি কেবল সুবিধাটুকু নিয়ে আবার সেই পথকে গর্ত ও খানাখন্দ ভরে তুলেছি।

তাই তো দেখি আমাদের চলাচল কখনো কোথাও শ্লথ হয়ে যাচ্ছে। কখনো খানাখন্দের ভয়ে আবার পেছনের দিকে ছুটে চলেছি। তার সঙ্গে এখানেই আমাদের যোজন যোজন পার্থক্য। তিনি এবং তার সময়ের সহযোদ্ধারা নিজের ভেতর থেকে শক্তি সঞ্চয় করে, সাহস সঞ্চার করে অশুভকে নাশ করতে রাস্তায় নেমেছিলেন আর আমরা কেবল শামুকের মতো গুটিয়ে যাই খোলসের ভেতরে। আমরা কেবল ঢুকে থাকি মোড়কের ভেতরে। চকচকে ঝকঝকে খোলস ও মোড়কের ভেতরে কেবল আমাদের দেহকে নয় আমাদের আত্মাকেও গুটিয়ে রাখি। হয়তো বিক্রি করে দিই, না হয় বন্ধক দিয়ে রাখি।

আমাদের এ অবক্ষয় তার জীবদ্দশায়ই কিছুটা শুরু হয়েছিল। তিনি একবার দুঃখ করে বলেছিলেন- ‘আজকাল দেখি অনেকেই তিন হাজার টাকার শাড়িকে ৩০০ টাকার বোরখায় ঢেকে রাখেন।’ কথাটার অনেক তাৎপর্য আছে। অনেকভাবে এর ব্যখ্যা করা যায়। এই যে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সুপারিশটা দিল- ইউএনও পদে নারী থাকলে মুক্তিযোদ্ধাদের মৃতদেহকে গার্ড অব অনার দিতে পারবে না, এমন আবদার করার সাহস কী করে পেল? কেবল কি এই যে এদের মধ্যে রাজাকার, মৌলবাদি, তেঁতুলতাত্বিকদের ভূত আছে বলে? দেশের রাজনীতিতে, প্রশাসনে, সাধারণ মানুষের মাঝে সাম্প্রদায়িকতা মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে বলে? কিন্তু কীভাবে তা ঘটল? কেন মানুষ আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা থেকে সরে গেল? আজ থেকে ১০০ বছর আগে একজন কিশোরী বা তরুণী সুফিয়া কামাল যার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছিল না তিনি সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার জন্য, সমাজসেবার জন্য, মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলবন্ধন তৈরির জন্য পরিবারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও পরিবারের পর্দা বা বোরখার অন্ধকার ছিন্ন করে বাইরে বেরিয়ে এলেন নারী সত্তার বিকাশের জন্য, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য, যে-তিনি একজন মানুষ হিসাবে তার ইচ্ছার কিছু দাম আছে তার জন্য। তার যা ভালো লাগে, যা করতে মন চায় তা করার অধিকার সে রাখতে পারে তার জন্য।

নারীর প্রথম পরিচয় সে মানুষ। কিন্তু এখন আমরা কী দেখি? রবীন্দ্রনাথের সেই লাইন- ‘রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি’র মতো রেখেছ নারী করে মানুষ করনি! দেখি আমাদের সমাজের শিক্ষিত নারীদের বিরাট একটা অংশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ শিক্ষিত ডিগ্রিধারী হয়েও এমনকি প্রশাসনের উচ্চপদে চাকরি করেও তাদের দামি পোশাক সে শাড়ি বা থ্রি পিস হোক তাসহ তাদের ডিগ্রি পদ-পদবি ও পর্দা নামের খোলসের ভেতরে ঢুকিয়ে নিজেকে মানুষ হিসাবে নয় শুধুই একজন নারী হিসাবে প্রকাশ করেন। তারা বোঝেন না যে তাদের এ গেটআপ তার নারী পরিচয়কেই বড় করে তুলে যে নারী শুধু একজন মাংসপিণ্ড, পুরুষের লালসার বস্তু তাই তাকে লুকিয়ে রাখতে হয়। ঢেকে রাখতে হয়। উচ্চশিক্ষিত নারীরা উচ্চপদে চাকরি করেও যখন এ মানসিক ঘেরাটোপ থেকে বের হতে পারেন না তখন সেসব অসভ্য পুরুষেরা নারীকে মানুষ ভাবতে পারে না। আমাদের সংস্কৃতিও এখন এ ঘেরাটোপের ভেতরে আটকা পড়ে গেছে। কিন্তু পর্দার মানে তো শালীনতা। আর শালীনতা বজায় রাখার কথা শুধু যে কেবল নারীর জন্যই বলা হয়েছে তাও তো নয়। সভ্য মানুষ মাত্রই সে নারী পুরুষ যেই হোক তার শালীনতাবোধ থাকবে।

সুফিয়া কামাল কি শালীনতা বিবর্জিত ছিলেন? তার রুচিশীল পোশাকের শুভ্রতা, তার বাচনিক স্নিগ্ধতা, মধুর ভাষণ, স্মিত হাসি সব মিলিয়ে যে মার্জিত রূপের এক মানুষ সেখানে মানুষের প্রতি মানুষের মানবিক সম্পর্কের বহমান ধারায় সবাই স্নাত হয়ে বিশুদ্ধ মানুষ হওয়ার পাঠ নিয়েছেন, যারাই তার কাছে গেছেন। তিনি দেখিয়ে গেছেন মানুষের কাছে মানুষের পরিচয় সবকিছুর আগে মানুষ হিসাবেই। নারী বা পুরুষ হিসাবে নয়। তাই নারীর কাজ পুরুষের কাজ বলে কোনো বিভাজন নেই।

আজ আমরা জেন্ডার বৈষম্য নিয়ে কথা বলি। আজকের যুগে জেন্ডার ধারণা একটা একাডেমিক পাঠ্য বিষয়। কিন্তু সেই কতকাল আগে সুফিয়া কামাল তার শৈশবেই তা বুঝে গিয়েছিলেন। মেয়েশিশুদের স্কুলে গিয়ে পাঠ গ্রহণের অধিকার না থাকার পারিবারিক ও সামাজিক বাধা নিষেধ ভাঙার প্রয়াস ছিল স্কুলে যাওয়ার জেদ থেকেই। শেষ পর্যন্ত পরিবার থেকে স্কুলে পাঠানো হয়েছিল তাকে। টুপি আচকান পরিয়ে। তবে বেশিদিন নয়। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল স্কুল। তাই বলে থেমেও থাকেননি। বাড়িতে মামার লাইব্রেরিকে বানিয়েছিলেন পাঠশালা। মায়ের সহায়তায় বানান করে করে পড়েছেন নজরুলের হেনা। পড়েছেন শুধু নয় লিখেছেন সেই শৈশব থেকেই। লেখাপড়াই ছিল তার খেলা।

পরবর্তী সময়ে তিনি যখন ছোটদের জন্য লিখেছেন আজিকার শিশু কবিতা, সেখানে বলেছেন, ‘আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা, তোমরা এখন সেই বয়সে লেখা পড়া নিয়ে করো মেলা।’ তিনি নিজেকে মেয়েদের এই পুতুল খেলার ঘেরাটোপ থেকে বের করে নিয়ে এসেছিলেন এবং সারা জীবন চেষ্টা করেছেন সব মেয়ে এ পুতুল খেলার চক্র থেকে বেরিয়ে আসুক। এ লেখালেখির সূত্রেই বাইরের জগতের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে গিয়েছিল। এ পরিচয় একতরফা নয়। শুধু যে তিনি চিনতেন বড় বড় মানুষদের তাও নয়। তাকেও চিনে নিয়েছিলেন সেই সময়ের বড় বড় মানুষেরা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি নজরুল রোকেয়া সাখাওয়াতসহ আরও অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল তার। কেননা তত দিনে তার লেখা ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। বাইরের পৃথিবী তাকে টানছিল। লেখালেখির পাশাপাশি সমাজ সেবার কাজ, নারী জাগরণের অদম্য আগ্রহ নিয়ে তিনি বরিশালে সাবিত্রী দেবী, মনোরমা মাসিমাদের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন মাতৃমন্দিরে। নারীকে পুঁথিগত ও কর্মমুখী শিক্ষা দিয়ে স্বাবলম্বী করে নারীর জীবন মান উন্নত করার জন্য সে কাজে তিনি সানন্দে অংশগ্রহণ করতেন। একটা মুক্ত জীবনের স্বাদ পেতেন এসব কর্মে।

তিনি বলেছেন, তার স্মৃতিচারণে-‘ফিরে এলাম বরিশালে। তখন লেখাও চলল আর শুরু হলো সেই সময়েই সামান্য করে সমাজসেবার কাজ। সুকুমার দত্তের স্ত্রী বিএ পাশ করে বরিশাল এলেন- মাতৃমঙ্গল, শিশুসদন, সমিতি করলেন। বরিশাল বালিকা বিদ্যালয়ের মধ্যে সভা হতো। বোরখা পরে বন্ধ ঘোড়ার গাড়ি করে সাবিত্রী দিদির সঙ্গে যেতাম। কী হাস্যকর সে যাত্রা। তবুও কী অসীম তৃপ্তি লাভ করতাম অসহায়া, অশিক্ষিতা মায়েদের শিশুদের সঙ্গে। আমার তখনো শৈশব কাটেনি।’

বরিশালের সেই কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি যুক্ত হলেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম নামের সংগঠনে। সেই সংগঠন কাজ করত কলকাতার বস্তি এলাকায়। সেখানে তিনি সমিতির অনেক সদস্য যারা অধিকাংশই ছিলেন সুশিক্ষিত তাদের সঙ্গে পরিচিত হলেন এবং সেখানকার পিছিয়ে পড়া অশিক্ষিত দরিদ্র মুসলিম নারীদের লেখাপড়া ও হাতের কাজ শিখিয়ে তাদের স্বাবলম্বী ও সংগঠিত করার জন্য অংশগ্রহণ করেছেন। সে জন্য পরিবার ও সমাজ সব জায়গা থেকে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কিন্তু কোনো বাধা তাকে দমাতে পারেনি। অথচ তখন তার বয়স মাত্র ষোলো-সতেরো।

২২ বছর বয়সে বৈধব্য বরণের পর লেখালেখি ও অসহায় নারীদের জন্য কাজ করার সংকল্প অটুট রাখতে এবং নিজের স্বাধীন সত্তা বাঁচিয়ে রাখতে তিনি আর মামার পরিবারে না গিয়ে যখন কলকাতা শহরে মা আর শিশু কন্যাকে নিয়ে অনিশ্চিত জীবনে পাড়ি জমালেন তার পুঁজি ছিল শুধু অদম্য সাহস আর চরিত্রের দৃঢ়তা। যে কারণে কোথাও হেরে যাননি তিনি। কোথাও মাথা নোয়াতে হয়নি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও কলকাতা করপোরেশনে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছিলেন ৫০ টাকা বেতনে। আর লেখালেখি করেও আয় করেছেন। এরই মাঝে সময় বের করে সংগঠনের জন্য মানুষের জন্য কাজ করেছেন। তার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে। মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মালেকা বেগমের লেখা-‘১৯৩৩-১৯৩৯ কাল পর্বে আমরা পাই এমন এক ব্যক্তি সুফিযাকে, যিনি নারী সমাজের সামনে উদাহরণ হয়ে আছেন প্রতিবাদী, দৃঢ়চেতারূপে। লড়াই করে গেছেন রক্ষণশীল সমাজের নানাবিধ নারীবিরোধী অনুশাসন, ফতোয়ার বিরুদ্ধে।’

যখন দ্বিতীয়বার সংসার পাতলেন কামাল উদ্দিন খানের সঙ্গে আর তার কর্মস্থল বর্ধমানে চলে গেলেন সেখানে গিয়েও মনিকুন্তলা সেনের সঙ্গে মহিলা আÍরক্ষা সমিতিতে কাজ করেছেন। ১৯৪৬ এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার অসহায় মানুষদের জন্য কাজ করেছেন তারপর দেশভাগ হলে চলে এলেন ঢাকায়। সাহিত্যচর্চার মাধ্যমেও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চলতে লাগল। বেগম পত্রিকার দায়িত্ব পালনসহ প্রায় সব সাহিত্য সংস্কৃতি ও নারীর অধিকারবিষয়ক সংগঠনে নিজেকে যুক্ত রেখে নিজেকে ক্রমশ নির্মাণ করে চলেছেন বহুমাত্রিক কাজে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। এ সময়েই এলো বাংলাভাষার ওপর আঘাত। শুরু হলো ভাষা আন্দোলন। সে সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও যখনই বিপর্যয় এসেছে দেশে, যত সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি হয়েছে তার প্রতিষ্ঠায় ছিল তার অগ্রণী ভূমিকা। সব সময়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে জাতির বিপদে কাণ্ডারী হয়েছেন। আর সেই কৈশোর বয়স থেকে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার যে কাজে তিনি নেমেছিলেন তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ এ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। এ দেশে নারী আন্দোলন বিকশিত হয়েছে বিস্তৃত হয়ে একটা শক্তপোক্ত ভিত রচনা করেছে তার হাত ধরে। তার সমসাময়িক আরও অনেকেই নারী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন নারীর অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করেছেন। কিন্তু সুফিয়া কামাল ছিলেন একটা বাতিঘর। তিনি সবাইকে পথের দিশা দেখিয়ে গেছেন। শুধু যে দিশাহীন নারীসমাজকে তা নয় তিনি দিশা দেখিয়েছেন এ জাতিকে।

এ প্রসঙ্গে তাকে নিয়ে অধ্যাপক কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম-এর লেখা থেকে কয়েকটা লাইন উদ্ধৃত করছি ‘নারীর অধিকার আদাযের সংগ্রামে সুফিয়া কামালের প্রধান অবদান ছিল নারীর সার্বিক মুক্তির বিষয়টিকে একটি রাজনৈতিক সামাজিক-রাষ্ট্রিক বাধ্যবাধকতার বিষয়ে পরিণত করা। এ সংগ্রাম স্লোগানসর্বস্ব ছিল না; কোনো একটি বিশেষ কারণে, বিশেষ সময়ে গড়ে ওঠা কর্মোদ্যোগও ছিল না। এটি ছিল একটি জাতীয় অবশ্য কর্তব্য। সে জন্য কোনো বিচ্ছিন্ন নারীবাদী চিন্তা অথবা রাজনৈতিক বিবেচনা এ সংগ্রামকে প্রভাবিত করতে পারেনি। সুফিয়া কামালের কাছে এ সংগ্রামের একটি সামূহিক রূপ ছিল; একটি চিরায়ত তাৎপর্য ছিল। যদি নারী শিক্ষিত, আÍসচেতন, অধিকার সচেতন এবং ঘরের বাইরে কর্মোদ্যমী না হন তাহলে জাতি গঠনের কোনো পর্যায়ই সম্পূর্ণ হবে না। এ জন্য জাতি ও জাতির নানা আখ্যানের কেন্দ্রমূলে নারীর অধিকারের বিষয়টিকে তিনি স্থাপন করেছেন। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, নারীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশ যতটা সাফল্য এসেছে তার পেছনে সুফিয়া কামালের অবদান ছিল একজন পথপ্রদর্শকের এবং নিরলস যোদ্ধার।’

নারী অধিকার আন্দোলনের পথপ্রদর্শক সুফিয়া কামালের জাগরণী মন্ত্রে নারীরা আজ সর্বত্র এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকই কিন্ত তার অগ্রযাত্রার পথে এখনো অনেক বিরুদ্ধতা বিদ্যমান। আবার নতুন নতুন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে যেমন তথ্যপ্রযুক্তি মানুষের জীবনকে অনেক ক্ষেত্রে সহজ করে দিলেও নারী নির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতার নিত্য নতুন কৌশল আবিষ্কারে ভূমিকা রাখছে। কখনো আবার পুরোনো বিরুদ্ধতাগুলো নতুন করে সামনে আসছে। মৌলবাদ ধর্মান্ধতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মানহীন শিক্ষাব্যবস্থার কারণে কূপমণ্ডূকতা বাড়ছে সমাজে। যার ফলে তৈলাক্ত বাঁশের অংকের শামুকের মতো তিনফুট উঠে পাঁচফুট নেমে যেতে হয় কারণ, নারীর চলার পথ নতুন করে পিছলা হচ্ছে। তাই আজ জননী সাহসিকা সুফিয়া কামালের জীবনদর্শন চর্চা করা ভীষণ প্রয়োজন। একটা বিরুদ্ধ সমাজে সংগঠিত শক্তির মাধ্যমে কীভাবে লড়ে যেতে হয় লড়ে গিয়ে কীভাবে অধিকার আদায় করতে হয় সে মন্ত্রে নারীকে জাগাতে হবে। জাগাতে হবে মানুষকে। তার জন্য জননী সাহসিকা সুফিয়া কামালকে নিবিড়ভাবে পাঠ করতে হবে। কারণ একটা বিরুদ্ধ প্রতিকূল পরিবেশ থেকে নিজে বেরিয়ে এসে লাখো কোটি নারীর জন্য সৃষ্টি করলেন নতুন এক যুগ, নতুন চলার পথ, সেখানে দৃষ্টি প্রসারিত করি। তার থেকে দীক্ষা নিয়ে বিদ্যমান সব প্রতিবন্ধকতাকে দূর করে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে চলি।

২০ জুন নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের এ যুগস্রষ্টার জন্মদিন। আসুন আমরা সবাই তার প্রদর্শিত পথে হাঁটি। তাকে বারবার পাঠ করি। নারী মুক্তির মাঝে মানবমুক্তির তার যে লক্ষ্য ছিল সেই লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যাওয়ার সর্বাÍক প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাকে জন্মদিনের শ্রদ্ধা জানাই।